ইসরাইলি ইহুদি: নিপীড়িত থেকে নিপীড়ক ……মজিদ সম্রাট (লেখক ও কথাসাহিত্যিক)
1 min readফিলিস্তিনের ইতিহাস : আধুনিক ফিলিস্তিন ভূখণ্ড মধ্যপ্রাচ্যের দক্ষিণ-পশ্চিমে, ভূমধ্যসাগর এবং জর্ডান নদীর মাঝখানে অবস্থিত । মিশরীয় গবেষক ডঃ রাগিব সারজানি তাঁর বিভিন্ন রচনায় ফিলিস্তিনের বিস্তৃত ইতিহাস বর্ণনা করেছেন । পৃথিবীর যেসব অঞ্চলে প্রাচীন মানব সভ্যতা গড়ে উঠেছিল, ফিলিস্তিন তাদের মধ্যে অন্যতম । ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকেও আধুনিক ফিলিস্তিন এবং ইসরাইল ভূখণ্ড, মুসলিম, খ্রিস্টান সাথে ইহুদিদের কাছে সম গুরুত্বপূর্ণ । হযরত ইউসুফ (আ:)-এর পিতৃপুরুষেরা ছিলেন কেনানের (আধুনিক সিরিয়া, ইসরাইল, ফিলিস্তিন) অধিবাসী, হযরত দাউদ (আঃ), হযরত সুলায়মান (আ:) থেকে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) সবার জন্যই ফিলিস্তিন/ইসরাইল ভূখণ্ডটি স্মৃতিবিজড়িত । ফিলিস্তিন বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সাম্রাজ্যের দ্বারা শাসিত হয়েছে । দেশটি প্রাচীন কালে কেনানী, আরামীয়, মিশরীয়, ব্যাবিলনীয়, পারস্য, গ্রিক, রোমান বাইজেন্টাইন প্রভৃতি সভ্যতার অধীনে শাসিত হয়েছে । মুসলিমদের সময় উমাইয়া (রাজধানী দামেস্ক), আব্বাসীয় (রাজধানী বাগদাদ), সেলজুক (রাজধানী ইস্পাহান), ফাতেমীয় (রাজধানী রাক্কাদা, কায়রো), আইয়ুবী, মামলুক (রাজধানী কায়রো), উসমানীয় (রাজধানী ইস্তাম্বুল) প্রভৃতি শাসকদের অধীনে পরিচালিত হয়েছে। মাঝে কিছুদিন ইউরোপীয় খ্রিস্টান ক্রুসেডারদের দখলে ছিল দেশটি । ফিলিস্তিনের সর্বনাশ করা সর্বশেষ দখলদার ছিল ব্রিটিশরা ।
ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে ইসরাইল রাষ্ট্রের উদ্ভব : উইকিপিডিয়ার তথ্যমতে ১৫১৬ সালে যখন উসমানীয়রা ফিলিস্তিন দখল করে, তখন সেখানে ইহুদিদের সংখ্যা ছিল সাকুল্যে পাঁচ হাজার। ১৮৯০ সালে ফিলিস্তিনের মোট জনসংখ্যার মাত্র ৮ শতাংশ ছিল ইহুদি। ১৮৮২ থেকে ১৯০৩ সালের মধ্যে ৩৫ হাজার ইহুদি নানা কারণে রাশিয়ান জার সাম্রাজ্য ও রোমানিয়ায় নিজ বাস্তু হতে উৎখাত হয়ে ফিলিস্তিনে আশ্রয় নেয়। ১৯০৪ সাল থেকে ১৯১৪ সালের মধ্যে আরো ৩৫ থেকে ৪০ হাজার ইহুদি (অধিকাংশই রাশিয়ান জার সাম্রাজ্য হতে) অত্যাচারিত হয়ে ফিলিস্তিনে থিতু হয় । এতদসত্ত্বেও ১৯১৭ সালে ব্রিটিশ পররাষ্ট্র সচিব আর্থার বেলফোর কর্তৃক কুখ্যাত ‘বেলফোর ডিক্লেয়ারেশন’ – এর আগ পর্যন্ত ফিলিস্তিনে আরবদের সংখ্যা ছিল ৯০ শতাংশ আর ইহুদিদের সংখ্যা ছিল মাত্র ১০ শতাংশ।
তবে এটা অনস্বীকার্য যে, ইহুদিরা বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকেই বৈজ্ঞানিক গবেষণায় এবং অর্থকড়িতে পশ্চিমাদের সাথে পাল্লা দিয়ে চলতো। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ইহুদিরা অর্থকড়ি এবং বৈজ্ঞানিক তথ্য দিয়ে ধুঁকতে থাকা ব্রিটিশদের সাহায্য করার পুরস্কার স্বরুপ ফিলিস্তিনিদের জন্য সর্বনাশা ‘বেলফোর ডিক্লেয়ারেশন’ বা আরব ভূখণ্ডে ইজরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা ঘোষণা করা হয় । ‘বেলফোর ডিক্লেয়ারেশন’-এর পর ফিলিস্তিনে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে ইহুদিদের আগমনের হার ত্বরান্বিত হয়। ওদিকে আরব ভূখণ্ডে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে জনমত তৈরির লক্ষ্যে, ইহুদিরা নানা ধরনের অন্তরকলহ এবং গুপ্ত হত্যায় মেতে ওঠে । স্টার্ণ গ্যাং, হাগানা এরকম আরো অনেক সন্ত্রাসী সংগঠন আরবদের উপর হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, লুটতরাজ সমানতালে চালাতে থাকে। ফিলিস্তিনিদের জন্য মরার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দাঁড়ায় জার্মানিতে হিটলারের ক্ষমতারোহণ । হিটলার ছিল প্রচণ্ড ইহুদি বিদ্বেষী, তার সময় জার্মানিতে এবং পরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে দখলকৃত অন্যান্য ইউরোপীয় রাষ্ট্রে ইহুদিদের উপর অত্যাচার সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছয় । অমানুষিক অত্যাচারের শিকার হাজার হাজার ইহুদি প্রাণভয়ে পালিয়ে ফিলিস্তিনে আশ্রয় নেয় । দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে ইঙ্গ-মার্কিন চাপে জাতিসংঘ ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে ইসরাইল রাষ্ট্রের রুপেরেখা ঘোষণা করে । ইউরোপ থেকে গণহারে অত্যাচারিত ইহুদিদের স্থানান্তর সত্ত্বেও, ১৯৪৭ সালে ইহুদীরা জনসংখ্যায় ছিল ৩৩ শতাংশ আর আরবরা ৬৭ শতাংশ, ভূমির মালিকানায় ইহুদিরা ৬ শতাংশ, আরবরা ৯৪ শতাংশ। অথচ ঘোষিত ইহুদি রাষ্ট্রের রূপরেখায় জনসংখ্যায় সংখ্যালঘিষ্ঠ হয়েও ইহুদীরা ফিলিস্তিন ভূখণ্ডের ৫৬ শতাংশের ভাগীদার হয়, যার মধ্যে ছিল অধিকাংশ উপকূলীয় উর্বর ভূমি সহ অধিকাংশ অভ্যন্তরীণ মিঠা পানির জলাধার, এছাড়া ইহুদী রাষ্ট্রের উত্তর অংশের সীমানা অমীমাংসিত রাখা হয়, ফলে আজ অব্দি ইহুদীদের অবৈধ ভূমি গ্রাস চলেছেই ।
বর্তমান সংকট : আজ থেকে প্রায় ৮০ বছর আগে আরব ভূখণ্ডে ইহুদি অধ্যুষিত ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা হলেও, নিজ ভূমিতে ফিলিস্তিনিরা এখনো পরাধীন । বিগত ১০০ বছরে ইহুদিদের দ্বারা আরব ফিলিস্তিনিরা নানা সময়ে, নানা ভাবে, নানা অজুহাতে নির্যাতিত হয়েছে, সাথে সাথে নিপীড়িত ফিলিস্তিনিদের মনে ক্ষোভ-ও পুঞ্জিভূত হয়েছে । আর এসব ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে, নানা সময়ে অবৈধ ভূমি দখলদার ইহুদিদের উপর ছোটখাটো হামলার মাধ্যমে। ঠিক এভাবেই গত বছরের ৭ অক্টোবর ফিলিস্তিনের মুক্তিকামী সংগঠন হামাসের সদস্যরা প্যারাসুট নিয়ে ইসরাইলের সুরক্ষিত সীমানা প্রাচীর ডিঙ্গিয়ে, অতর্কিত হামলা চালিয়ে প্রায় ১২০০ জন ইসরাইলিকে হত্যা করে, সাথে কিছু সংখ্যক (২৪০ জন) লোককে জিম্মি করে গাজায় নিয়ে যায়। উদ্দেশ্য ছিল ইসরাইলি জিম্মিদের মুক্তির বিনিময়ে অধিক সংখ্যক ফিলিস্তিনি বন্দীর মুক্তি । তখন থেকে আজ পর্যন্ত ইজরাইলের নির্বিচার বোমা হামলায় গাজায় ৪০ হাজারের বেশি মানুষের (যা গাজার মোট জনসংখ্যার প্রায় ২ শতাংশ) মৃত্যু হয়েছে । আল জাজিরা সহ অন্যান্য নিরপেক্ষ সংবাদ মাধ্যমের তথ্য মতে, গাজার বসতি অবকাঠামোর প্রায় পুরোটাই ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে । ইজরাইলের নির্মম হামলায় গাজার ২০ লাখ ৪৭ হাজার জনসংখ্যার মধ্যে ১৯ লাখের বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়ে মানবতার জীবন যাপন করছে । ল্যানসেট সাময়িকির তথ্য মতে, এখুনি যদি যুদ্ধ বন্ধ হয় তারপরেও গাজার মোট জনসংখ্যার উল্লেখযোগ্য অংশের নানা কারণে মৃত্যু অবধারিত ।
পশ্চিমা দেশগুলো আত্মরক্ষার অজুহাত দেখিয়ে ইসরাইলের গণহত্যা কে বারবার বৈধতা দিয়ে যাচ্ছে। অথচ যারা অত্যাচারিত, যাদের সীমানা উন্মুক্ত, যাদের আকাশ অরক্ষিত, সংঘাতে পাথর, বন্দুক আর হালকা রকেট যাদের শেষ ভরসা, তাদের আত্মরক্ষার অধিকার নেই ! বরং যাদের সীমানা সুউচ্চ কংক্রিট সমেত দুর্ভেদ্য কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ঘেরা, যাদের আকাশ আয়রন ডোম দ্বারা সুরক্ষিত, যাদের রয়েছে পৃথিবীর সেরা অস্ত্র দিয়ে সজ্জিত সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনী, স্বীকার না করলেও যাদের অস্ত্রভান্ডারে রয়েছে পারমাণবিক বোমা, পশ্চিমাদের মতে তারাই আত্মরক্ষার প্রকৃত হক্বদার !
পশ্চিমাদের দ্বিচারিতা : জাতিসংঘের সংস্থা ইউএনএইচসিআর-এর তথ্য মতে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর এখন পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ১১ হাজার বেসামরিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে । যুদ্ধের দায় রাশিয়ার কাঁধে চাপিয়ে, অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু করার জন্য পশ্চিমারা দেশটির উপর নজিরবিহীন নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে । রাশিয়াকে পরাজিত করতে ইউক্রেনকে কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থ আর বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র সরবরাহ করে যাচ্ছে পশ্চিমা দেশগুলো । অথচ গাজায় ইসরাইলের নির্বিচার বোমাবাজিতে প্রায় ৪১ হাজার বেসামরিক ফিলিস্তিনির মৃত্যু হলেও, পশ্চিমা দেশগুলো ইসরাইলের উপর নিষেধাজ্ঞা তো দূরের কথা বরং কূটনৈতিক সমর্থন আর অস্ত্র সরবরাহ করে মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘায়িত করছে ! তাদের কাছে ইউরোপের সাদা চামড়ার মানুষের জীবনের মূল্য পর্বতসম হলেও ফিলিস্তিন, ইরাক, সিরিয়া প্রভৃতি দেশের মানুষের জীবন নিতান্তই তুচ্ছ । ইউক্রেন আক্রমণের জন্য রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন আইসিসির গ্রেফতারি পরোয়ানা নিয়ে অনেকটাই একঘরে, এদিকে গাজায় গণহত্যার জন্য ইসরাইলের প্রেসিডেন্ট বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির চেষ্টায় আইসিসির প্রধান কৌশলী করিম খান নিজেই একঘরে।
ফিলিস্তিনে ইসরাইলের নির্মম হামলা নিয়ে মিডিয়ার দ্বিচারিতাও চোখে পড়ার মতো ! মিডিয়া ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলাকে নির্মম ‘আগ্রাসন’ বললেও, ফিলিস্তিনে ইসরাইলের নির্বিচার গণহত্যাকে ‘হামলা’ বলে চালিয়ে দিচ্ছে । এদিকে পশ্চিমা দেশগুলোয় ইসরাইলি গণহত্যার প্রতিবাদে মানুষ রাস্তায় বিক্ষোভ করলে বা মিডিয়ায় ইসরাইলের বিপক্ষে কিছু লিখলে বা স্পর্শকাতর ছবি ছাপলে সেগুলোকে পশ্চিমা নেতারা প্রকাশ্যে পশ্চিমা চেতনা বিরোধী বলে তোপ দাগছে !
ওদিকে মধ্যপ্রাচ্যের রাজা বাদশাহগণ নিজেদের ক্ষমতার চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করতে তাদের পশ্চিমাদের ফরমায়েশ পালনে সদা জাগ্রত । রাশিয়ার একনায়কতন্ত্র, ইরানের গণতন্ত্র নিয়ে পশ্চিমাদের বিস্তর অভিযোগ অথচ মধ্যপ্রাচ্যের রাজাধিরাজদের সাথে তাদের সেই দহরম মহরম সম্পর্ক । চীনের কমিউনিস্ট পার্টির শাসন নিয়ে তাদের সমালোচনার শেষ নেই অথচ স্বার্থের জন্য সিঙ্গাপুরের এক দলীয় শাসন এমনকি ভিয়েতনামের কমিউনিস্ট শাসন তাদের কাছে সোনায় সোহাগা।
দখলদার ইসরাইলের কাঁধে যতদিন পশ্চিমাদের হাত আছে ততদিন ইজরাইলকে কোনভাবেই থামানো যাবে না ।
শেষ কথা : ইসরাইলে বসবাসরত বর্তমান ইহুদিদের অধিকাংশই ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে বিভিন্ন সময়ে নির্যাতিত হয়ে ফিলিস্তিনে বসতি গড়েছে । এদের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ ইহুদি আবার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলারের নির্মম নির্যাতন সহ্য করে, রক্তাক্ত হয়ে, নিজেদের ওষ্ঠাগত প্রাণ কোনক্রমে হাতে নিয়ে ফিলিস্তিনে এসেছে । ভাবতে অবাক লাগে, সেইসব নির্যাতিত, নিপীড়িত ইহুদীরা নিজেরাই আজ নিপীড়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ, নিরীহ ফিলিস্তিন হত্যাযজ্ঞের পাশবিক উল্লাসে মেতে উঠেছে তারা ।